Sunday, November 7, 2010

(সুরা ইউসুফ : ৩৬-৪৯) : স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেয়ার গল্প এবং কারাগারে দাওয়াত দানের পদ্ধতি ও কৌশল

৩৬) কারাগারে ৩১ তার সাথে আরো দু’টি ভৃত্যও প্রবেশ করলো৷ ৩২ একদিন তাদের একজন তাকে বললো, “আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি মদ তৈরী করছি৷” অন্যজন বললো, “আমি দেখলাম আমার মাথায় রুটি রাখা আছে এবং পাখিরা তা খাচ্ছে৷” তারা উভয়ে বললো, “আমাদের এর তা’বীর বলে দিন৷ আমরা আপনাকে সৎকর্মশীল হিসেবে পেয়েছি৷” ৩৩

*৩১. হযরত ইউসুফকে যখন কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তখন সম্ভবত তাঁর বয়স বিশ একুশ বছরের বেশী ছিল না৷ তালমূদে বলা হয়েছে, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন তিনি মিসরের শাসনকর্তা হন তখন তাঁর বয়স ছিল তিরিশ বছর৷ এদিকে কুরআন বলছে, কারাগারে তিনি (আরবী) অর্থাৎ কয়েক বছর কাটান৷ (আরবী) শব্দটি আরবী ভাষায় ১০ পর্যন্ত সংখ্যার জন্য বলা হয়ে থাকে৷

*৩২. হযরত ইউসুফের সাথে এই যে দু'জন গোলাম কারাগারে প্রবেশ করেছিল তাদের সম্পর্কে বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, তাদের একজন ছিল মিসরের বাদশাহর মদ পরিবেশকদের সরদার এবং দ্বিতীয়জন রাজকীয় রুটি প্রস্তুকারকদের অফিসার৷ তালমূদের বর্ণনা মতে, মিসরের বাদশাহ তাদের এ অপরাধে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন যে, একবার এক দাওয়াতের মজলিসে পরিবেশিত রুটি একটু বিস্বাদ লেগেছিল৷ এবং একটি মদের পাত্রে পাওয়া গিয়েছিল মাছি৷

*৩৩. কারাগারে হযরত ইউসুফকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হতো এ থেকে তা আন্দাজ করা যেতে পারে৷ ওপরে যেসব ঘটনার কথা আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সামনে রাখলে ব্যাপারটা আর মোটেই বিস্ময়কর মনে হয় না যে, এ কয়েদী দু'জন হযরত ইউসুফের কাছেই-বা এসে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলো কেন এবং তাঁকে "আমরা আপনাকে সদাচারী হিসেবে পেয়েছি" বলে শ্রদ্ধার্ঘ পেশ করলো কেন৷ জেলখানার ভেতরে বাইরে সবাই জানতো, এ ব্যক্তি কোন অপরাধী নয়, বরং একজন হুকুম মেনে চলার প্রমাণ পেশ করেছেন৷ আজ সারাদেশে তাঁর চেয়ে বেশী সৎব্যক্তি আর কেউ নেই৷ এমনকি দেশের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যেও তাঁর মতো লোক একজনও নেই৷ এ কারণে শুধু কয়েদীরাই তাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতো না রবং কয়েদখানার পরিচালকবৃন্দ এবং কর্মচারীরাও তাঁর ভক্তদলে শামিল হয়ে গিয়েছিল৷ বাইবেলে বলা হয়েছেঃ "কারা রক্ষক কারাস্থিত সমস্ত বন্দির ভার যোসেফের হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং তথাকার লোকদের সমস্ত কর্ম যোসেফের আজ্ঞা অনুসারে চলিত লাগিল৷ কারারক্ষক তাঁহার হস্তগত কোন বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিতেন না৷" (আদি পুস্তক ৩৯: ২২, ২৩)

৩৭) ইউসুফ বললো : “এখানে তোমরা যে খাবার পাও তা আসার আগেই আমি তোমাদের এ স্বপ্নগুলোর অর্থ বলে দেবো৷ আমার রব আমাকে যা দান করেছেন এ জ্ঞান তারই অন্তরভূক্ত৷ আসল ব্যাপার হচ্ছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং আখেরাত অস্বীকার করে তাদের পথ পরিহার করে৷

৩৮) আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের পথ অবলম্বন করেছি৷ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়৷ আসলে এটা আমাদের এবং সমগ্র মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ (যে, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারোর বান্দা হিসেবে তৈরী করেননি) কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না৷

৩৯) হে জেলখানার সাথীরা! তোমারা নিজেরাই ভেবে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ, যিনি সবার ওপর বিজয়ী৷”

৪০) তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের বন্দেগী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন প্রমাণ পাঠাননি৷ শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই৷ তাঁর হুকুম- তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না৷ এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না৷

৪১) হে জেলখানার সাথীরা! তোমাদের স্বপ্নের তা’বীর হচ্ছে, তোমাদের একজন তার নিজের প্রভুকে (মিসর রাজ) মদ পান করাবে আর দ্বিতীয় জনকে শূলবিদ্ধ করা হবে এবং পাখি তার মাথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে৷ তোমরা যে কথা জিজ্ঞেস করছিলে তার ফায়সালা হয়ে গেছে৷

৪২) আবার তাদের মধ্য থেকে যার সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে ইউসুফ তাকে বললো : “তোমার প্রভুকে (মিসরের বাদশাহ) আমার কথা বলো৷” কিন্তু শয়তান তাকে এমন গাফেল করে দিল যে, সে তার প্রভুকে (মিসরের বাদাশাহ) তার কথা বলতে ভুলে গেলো৷ ফলে ইউসুফ কয়েক বছর কারাগারে পড়ে রইলো৷ *৩৪

*৩৪. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, "শয়তান হযরত ইউসুফকে তাঁর রবের (অর্থাৎ আল্লাহ) স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয় এবং তিনি এক বান্দার কাছে চান যে, সে তার রবের (মিসরের বাদশাহর) কাছে তার কথা আলোচনা করে তার কারামুক্তির চেষ্টা করুক, তাই আল্লাহ তাঁকে কয়েক বছর জেলখানা পড়ে থাকার শাস্তি দেন৷"

মূলত এটি পুরোপুরি একটি ভুল ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেমন আল্লামা ইবনে কাসীর এবং প্রথম যুগের তাফসীরকারদের মধ্যে মুজাহিদ, মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইত্যাদি তাফসীরকারগণ বলেন, (আরবী) (শয়তান তাকে ভুলিয়ে দেয় তার রবের বা প্রভুর স্মরণ) এর মধ্যে "তার" বলতে সেই ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যার সম্পর্কে হযরত ইউসুফের ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে এবং এ আয়াতের মানে হচ্ছে, "শয়তান তার প্রভুর কাছে হযরত ইউসুফের বিষয়টা উত্থাপন করার কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল৷" এ প্রসংগে একটি হাদীসও পেশ করা হয়৷ হাদীসটিতে বলা হয়েছেঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "ইউসুফ আলাইহিস সালাম যে কথা বলেছিলেন সে কথা যদি তিনি না বলতেন তাহলে তিনি কয়েক বছর কারাগারে আটক থাকতেন না৷" কিন্তু আল্লামা ইবনে কাসীর বলেছেনঃ "এ হাদীস যে ক'টি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে সব কটিই দুর্বল৷ কোন কোন সুত্রে এটি "মরফূ" হাদীস৷ সেখানে বর্ণনাকারী হচ্ছে সুফিয়ান ইবন ওয়াকী' ও ইবরাহীম ইবনে ইয়াযীদ৷ এরা উভয়ই অনির্ভরযোগ্য৷ আবার কোন কোন সূত্রে এটি "মুরসাল" হাদীস৷ কিন্তু এ ধরনের বিষয়ে মুরসাল হাদীসের ওপর ভরসা করা যেতে পারে না৷" এ ছাড়া একজন মজলুম ব্যক্তি নিজের মুক্তির জন্য পার্থিব পন্থা অবলম্বন করাকে আল্লাহ থেকে গাফলতির ও তাঁর প্রতি অনির্ভরশীলতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হবে -একথা যুক্তির দিক দিয়েও গ্রহণযোগ্য নয়৷

৪৩) একদিন বাদশাহ বললো, “আমি স্বপ্ন দেখেছি, সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও সাতটি শুকনো শীষ৷ হে সভাসদবৃন্দ! আমাকে এ স্বপ্নের তা’বীর বলে দাও, যদি তোমরা স্বপ্নের মানে বুঝে থাকো৷”৩৭

৩৭. বাইবেল ও তালমূদের বর্ণনা মতে এ স্বপ্ন দেখার পর বাদশাহ বড়ই পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন৷ তিনি সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে নিজের রাজ্যের বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল গোষ্ঠী, জ্যোতিষী, গণক, দর্মীয় নেতা ও যাদুকরদের একত্র করে তাদের সবার সামনে এ স্বপ্ন পেশ করেছিলেন৷

৪৪) লোকেরা বললা, “এসব তো অর্থহীন স্বপ্ন, আর আমরা এ ধরনের স্বপ্নের মানে জানি না৷”

৪৫) সেই দু’জন কয়েদীর মধ্য থেকে যে বেঁচে গিয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে এখন যার মনে পড়েছিল, সে বললো, “আমি আপনাদের এর তা’বীর বলে দিচ্ছি, আমাকে একটু (কারাগারে ইউসুফের কাছে) পাঠিয়ে দিন৷” ৩৮

৩৮. কুরআন এখানে ঘটনার আলোচনা সংক্ষেপে সেরে দিয়েছে৷ বাইবেল ও তালমূদে এর যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে (বস্তুত যুক্তির আলোকে এ বিবরণই সঠিক মনে হয়৷) তা হচ্ছে এইঃ মদ পরিবেশকদের সরদার ইউসুফ আলাইহিস সালামের অবস্থা বাদশাহর কাছে বর্ণনা করে এবং এ সংগে জেলখানার তাদের স্বপ্ন এবং হযরত ইউসুফ (আ) তার যে তা'বীর করেছিলেন আর এ তা'বীর যেভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে তা সবই তার সামনে তুলে ধরে৷ শেষে সে বাদাশাহর কাছে আবেদন করে, আমি জেলখানায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে এর তা'বীর জিজ্ঞেস করে আসবো, আমাকে সেখানে যাবার অনুমতি দেয়া হোক৷

৪৬) সে গিয়ে বললো, “হে সত্যবাদিতার প্রতীক ইউসুফ! ৩৯ আমাকে এ স্বপ্নের অর্থ বলে দাও : সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি শীষ সবুজ ও সাতটি শীর্ষ শুকনো সম্ভবত আমি লোকদের কাছে ফিরে যেতে পারবো এবং তারা জানতে পারবে৷৪০

৪০. অর্থাৎ তারা আপনার মর্যাদা ও মূল্য বুঝতে পারবে৷ তারা অনুভব করতে পারবে কত উঁচুদরের বক্তিত্বকে তারা কোথায় আটকে রেখেছে৷ এভাবে আপনার সাথে কারাবাসের সময় আমি যে ওয়াদা করেছিলাম তা পূর্ণ করার সুযোগ আমি পেয়ে যাবো৷

৪৭) ইউসুফ বললো, “তোমরা সাত বছর পর্যন্ত লাগাতার চাষাবাদ করতে থাকবে৷ এ সময় তোমরা যে ফসল কাটবে তা থেকে সামান্য পরিমাণ তোমাদের আহারের প্রয়োজনে বের করে নেবে এবং বাদবাকি সব শীষ সমেত রেখে দেবে৷

৪৮) তারপর সাতটি বছর আসছে বড়ই কঠিন৷ এ সময়ের জন্য তোমরা যে শস্য জমা করবে তা সমস্ত এ সময়ে খেয়ে ফেলা হবে৷ যদি কিছু বেঁচে যায় তাহলে তা হবে কেবলমাত্র সেটুকুই যা তোমরা সংরক্ষণ করবে৷

৪৯) এরপর আবার এক বছর এমন আসবে যখন রহমতের বৃষ্টি ধারার মাধ্যমে মানুষের আবেদন পূর্ণ করা হবে এবং তারা রস নিংড়াবে৷” ৪১

৪১. মূল ভাষ্যে (আরবী) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর শাব্দিক মানে হচ্ছে 'নিংড়ানো'৷ এখানে এর মাধ্যমে পরবর্তীকালের চতুরদিকের এমন শষ্য শ্যামল তরতাজা পরিবেশ বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য যা দুর্ভিক্ষের পর রহমতের বৃষ্টিধারা ও নীলনদের জোয়ারের পানি সিঞ্চনের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে৷ জমি ভালোভাবে পানিসিক্ত হলে তেল উৎপাদনকারী বীজ, রসাল ফল ও অন্যান্য ফলফলাদি বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং ভালো ঘাস খাওয়ার কারণে গৃহপালিত পশুরাও প্রচুর পরিমাণে দুধ দেয়৷ হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এ তা'বীরে শুধুমাত্র বাদশাহর স্বপ্নের অর্থ বর্ণনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি বরং তিনি এ সংগে প্রাচুর্যের প্রথম সাত বছরে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা ও শস্য সংরক্ষণ করার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে তাও বলে দিয়েছেন৷ এ ছাড়াও তিনি দুর্ভিক্ষে পরে সুদিন আসার সুখবরও দিয়েছেন অথচ বাদশাহর স্বপ্নে এর কোন উল্লেখ ছিল না৷

No comments:

Post a Comment